ওরা পাঁচজন। কারো বয়স ১৫, কারো ১৬। ঐসময় তারা স্বপ্ন দেখেন অন্ধকারাচ্ছন্ন তাদের গ্রামে আলো জ্বালানোর। সেই থেকেই তাদের পথচলা শুরু। সমাজ পরিবর্তনে এ পাঁচ কিশোর যে স্বপ্ন দেখেছিল। যুবক বয়স শেষে ঢলে পরা বার্ধক্যতে এসে অর্ধচন্দ্রের মতো প্রতিদিনই একটু একটু করে পূরন হচ্ছে তাদের সে স্বপ্ন। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার জিন্দা গ্রাম এখন সারাদেশে মডেল গ্রামের স্বীকৃতি লাভ করেছে। গ্রামীন সৌন্দর্যকে নিংড়ে গড়া তোলা জিন্দা পার্ক সবুজায়নে একাধিকবার পেয়েছে রাষ্ট্রীয় পুরুস্কার। প্রাকৃতিক নৈস্বগীয় জিন্দা পার্ক নিজ চোখে দেখলে যে কারো চোখ ছানা বড়া হয়ে যাবে। যেখানে সময় কাটালে মন হবে ফুরফুরে। পার্কটি চলে মূলত রাষ্ট্রীয় কাঠামো অনুসারে। ৫ কিশোরের দেখা স্বপ্ন ‘ অপস’ অগ্র পথিক পল্লী সমিতি‘র পথে হেটে স্থানীয় ৮ হাজার মানুষ হয়েছে স্বাবলম্ভী। জিন্দা শুধু পার্ক নয় এটি একটি সামাজিক কাঠামো। এখানে রয়েছে স্কুল, কলেজ, কবরস্থান, মসজিদ, গ্রন্থালয়, কমিউনিটি ক্লিনিক। এছাড়া যৌতুকবিহীন বিয়েতে সহায়তা, মাদকাসক্ত যুবকদের ফিরিয়ে আনা, দূর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা, বেকার লোজকনের কর্মসংস্থানসহ নানা সামাজিক মূলক কর্মকান্ডে জিন্দা পার্ক কর্তৃপক্ষ সহযোগীতা করে থাকে। তাইতো গ্রাম বদলে দেয়ার একটি বেসরকারি উদ্যোগ সারাদেশে হয়ে উঠেছে মডেল গ্রাম।
যাত্রা শুরুর কথা ঃ ১৯৮০ সালে রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের জিন্দা গ্রামের কিশোর তোবারক হোসেন কুসুম, কাজী নাসিরউদ্দিন, শাহাদৎ হোসেন খোকন, কাজী মাহবুবুল আলম বাবুল, তাবারক হোসেন আকন এই পাঁচজন স্বপ্ন দেখেন তাদের গ্রামের অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ ব্যবস্থা থেকে মুক্ত করা, মানুষের দুঃখ-দূর্দশা লাঘব, শিক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, যৌতুকের ভয়াল থাবা থেকে গ্রামবাসীকে মুক্ত করা, বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচানো, গ্রামকে বিদ্যুৎতায়ন করা আর গ্রামের সব সময়ের সমস্যা একটি কবরস্থান প্রতিষ্ঠার। সেসময় তারা সপ্তাহে ১৩ টাকা করে চাদা নিয়ে (মোট ৬৫) অগ্নিবীণা স্টুডেন্টস ফোরাম নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেন। এরপর আর তাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাদের ডাকে সাড়া দিতে থাকে এলাকার আরো অনেকে। একপর্যায়ে অগ্নিবীণা স্টুডেন্টস ফোরাম নাম বদলে হয় অগ্রপথিক পল্লী সমিতি।
গ্রাম বদলে দেওয়ার গল্প ঃ অগ্রপথিক পল্লী সমিতির মাধ্যমে এ পাঁচ কিশোর ঐসময় দাউদপুরের জিন্দা উত্তরপাড়া, জিন্দা মধ্যপাড়া, জিন্দা দক্ষিণপাড়া, কামতা মনোহরপুর, তিন ওলপ, বইলদা, ওলপ কালনী ও হিন্দু অধ্যুষিত খাইলশা গ্রামের চেহারা বদলে দেয়। এসব গ্রামগুলোতে ৮০’র দশকে ছিলনা কোন রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা এমনকি মানুষের শেষ ঠিকানা কবরস্থানও। এরা উদ্যোগ নিয়ে গ্রামের রাস্তা ও সাকো নির্মাণ করে। এরপর স্কুল, মসজিদ, ঈদগাহ ও কবরস্থান তৈরি করে। একপর্যায়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সহায়তায় এগিয়ে যায় তারা। কেউ বিদেশে যেতে চাইলে, কেউ ব্যবসা করতে চাইলে কিংবা কারো চাকুরীর জন্য টাকার প্রয়োজন হলে তাদের টাকা দিয়ে সহযোগীতা করা হয়। অগ্রপথিক সমিতির সহযোগীতায় ৮ টি গ্রামসহ আশপাশের আরো অনেক গ্রামের মানুষ আজ স্বাবলম্বী। গ্রামগুলোর সমাজ ব্যবস্থা বদলে যাওয়ার পাশাপাশি বদলে গেছে মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নও। অগ্রপথিক সমিতির সহায়তায় আজ স্বাবলম্বী এমনই একজন জিন্দা উত্তরপাড়া গ্রামের আবুল হাশেম খান। তিনি বলেন, এহান থেইক্যা টেকা নিয়া ৮৮’সালে সৌদি যাই। এহন আমার উত্তরায় বাড়ী আছে, বিমান বন্দরে ব্যবসা আছে। খাইলশা গ্রামের গোপাল চন্দ্র। ২০০৫ সালে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে পোল্ট্রি ব্যবসা শুরু করেন। আজ সে স্বাবলম্বী। গোপাল চন্দ্র বলেন, একসময় নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। এখান থেইক্যা টাকা নিয়া ব্যবসা কইরা ভালা আছি। এছাড়া যৌতুকবিহীন বিয়েতে সহায়তা, মাদকাসক্ত যুকবদের ফিরিয়ে আনতে ব্যবসার টাকা দিয়ে সহায়তাসহ নানা কাজে সহযোগীতা করে থাকে ‘অপস’। সমিতির প্রায় ৮ হাজার সদস্যদের কেউ বেকার থাকলে অপসেই তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। যৌতুকমুক্ত হয়েছে জিন্দা গ্রামসহ আশেপাশের ৫/৬ গ্রাম। এখানকার ছেলেমেয়েরা বিয়েতে যৌতুকপ্রথাকে অভিশাপ মনে করেন। ৯০ শতাংশ লোক আজ অন্তত অক্ষরজ্ঞান জানার তালিকার রয়েছেন।
নৈসর্গিক পার্ক ঃ সামাজিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি জিন্দা এলাকায় একশ বিঘার উপড়ে জমি নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে প্রাকৃতিক নৈসর্গিক পার্ক। এ পার্কে রয়েছে লাভ লেকসহ আরো চারটি লেক। লেকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য রয়েছে স্প্রিডবোর্ড। রয়েছে ৮ টি কটেজ। দুর্লভ বৃক্ষসহ প্রায় ৫’শ প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে। পার্কের দক্ষিণ পাশে রয়েছে একটি কৃত্রিম ঝরণাধারা। রয়েছে পিরামিড, রেষ্টুরেন্ট। পার্কের পশ্চিমপাশে রয়েছে ঝাউবন। এছাড়া স্লিপার, দোলনাতো রয়েছেই। এককথায় পার্কটি নিজ চোখে দেখলে যেকারো চোখ ছানা বড়া হয়ে যাবে। পার্কের ভেতরেই গড়ে তোলা হয়েছে স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, মার্কেট, ফার্নিচার দোকান, কমিউনিটি ক্লিনিক ও নয়নাভিরাম ৫ তলা উচ্চাতা সম্পন্ন আধুনিক লাইব্রেরী। দর্শনার্থীদের সুবিধার কথা ভেবে পার্কের ৫ টি স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে ওয়াসরুম। পিকনিক স্পট রয়েছে ৬ টি।
জিন্দা সরকার মডেল ঃ জিন্দা সরকার মডেল। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাঠামো অনুসারে ও সাংবিধানিক নিয়মানুসারে পার্কের কার্যক্রম চলে বলে জানা যায়। জিন্দা সরকার মডেল চলে অপস সংসদের মাধ্যমে। প্রতিসপ্তাহে একবার সংসদ বসে। অপস সংসদের স্পীকার হচ্ছেন রুস্তম আলী সিকদার। নির্বাহী প্রেসিডেন্ট শফিকুল ইসলাম, কমিশনার জাকির হোসেন, কর্মবিভাগ ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আর প্রত্যেক সদস্য একেক জন সংসদ সদস্য। অপস সংসদের নির্দেশনা অনুযায়ী পার্ক পরিষ্কার, বাথরুম পরিষ্কার করাসহ নানা কাজ নিজেরাই করতে হয়। আর প্রত্যেক সদস্যের নামাজ পড়া সহ ধর্মীয় কর্মকান্ড বাধ্যতামূলক। মুসলিম সদস্যদেও যে নামাজ না পড়বে তার বেতন থেকে টাকা কেটে রাখা হবে। এছাড়া মাদকাসক্ত, যৌতুক নিয়ে বিয়ে করা, ভূমি দস্যুতার অভিযোগ, জুয়ারী কাউকে অপসের সদস্য পদ দেয়া হয়না।
দর্শনার্থীদের বক্তব্যঃ কথা হয় পার্কে আসা কয়েকজন দর্শণাথীর সঙ্গে। এদের মধ্যে একজন গৃহিনী রায়হানা সুলতানা কনা। তিনি বলেন, সত্যি পার্কটি দেখে আমি মুগ্ধ। দেশের আর কোথাও এমন প্রাকৃতিক নৈসর্গিক পার্ক আছে কিনা আমার জানা নেই। আরেক দর্শনার্থী মাসুদ চৌধুরী বলেন বলেন, পার্কটির নান্দনিকতা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। কোন রাইডস না থাকলেও মনখুলে ঘুরে বেড়ানোর একটি চমৎকার জায়গা জিন্দা পার্ক।
পার্কের কতৃপক্ষের বক্তব্য ঃ পার্কে কথা হয় পার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্টাতা তবারক হোসেন কুসুমের সঙ্গে। তিনি বলেন, এলাকার অন্ধকারাচ্ছন্ন, কুসংস্কারচ্ছন্ন দূর করার জন্যই ৮০ সালে স্বপ্ন দেখি। রূপগঞ্জের দুর্গম এলাকা ছিল জিন্দা। এলাকার উন্নয়ন আর দুঃখী মানুষের পরিবর্তনের কথা ভেবেই এ প্রয়াস। এখনো বিয়ে করেননি কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আরো অনেক কাজ বাকী আছে। যদি শেষ করতে পারি তাহলে বিয়ে করবো। কেন এমন উদ্যোগ নিলেন বলতেই সোজাসুজি উত্তর সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই এই উদ্যোগ। মৃত্যু পর্যন্ত সমাজ পরিবর্তনের কাজে নিজেকে নিবেদিত করার কথা জানান তিনি।
এখানেও আছে হতাশার গল্প ঃ স্বপ্ন পূরণের অন্তিম বেলায় বাধা হয়ে দাড়িয়েছে কতিপয় দখলবাজ লোক ও রাজধানী উন্নয়ন কতৃপক্ষ(রাজউক)। পার্কের এক’শ বিঘা জমির উপড় লোলুপ দুষ্টি পড়েছে তাদের। এনিয়ে রাজউকের সঙ্গে মামলায় লড়ছেন পার্ক কর্তৃপক্ষ। এখন জিন্দা পার্ক রক্ষায় এলাকাবাসীও সোচ্চার। তাদের দাবী, জান দেবে,তবুও জিন্দা দেবে না। পার্ক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানটি রক্ষায় এলাকাবাসী বিগত সময়ে এশিয়ান হাইওয়ে সড়ক অবরোধ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচী পালন করেছে। পার্কটি উচ্ছেদের জন্য বারবার বুলড্রোজার আর পুলিশের লাঠির সামনে দাড়াতে হয়েছে সদস্যদের। মিথ্যা ফৌজদারি মামলার পালিয়ে বেরিয়েছেন এর প্রতিষ্টাতারা। রাজধানী উন্নয়ন কতৃপক্ষ(রাজউক) পার্কটি পূর্বাচল উপ-শহরের আওতায় নিতে কয়েকহাজার পুলিশ,র্যার আর দাঙ্গা পুলিশ নিয়ে হাজির হয়। সেসময় দেশের বিশিষ্ট নাগরিকগন পার্কের পক্ষে দাড়ায়। হাজার হাজার শিক্ষার্থী গ্রামবাসী গায়ে কেরোসিন ঢেলে তাদের মমতাময় জিন্দাকে বাচাতে বন্দুকের নলের সামনে দাড়িয়ে পরেন। সে সময় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ(রাজউক) পার্কের সামনে রাজউক জিন্দা পার্ক নামে একটি সাইনর্বোড সাটিয়ে চলে যান। এরপর তারা এমুখো না হলেও সদস্যদের কর্মকান্ডে এখন সেই উদ্যোমে যেনো খানিকটা ভাটা পরে গেছে। সবাই রয়েছেন দখল হয়ে যাবার আশংকায়। ৫ কিশোরের স্বপ্ন দেখা জিন্দা আজ সারাদেশে মডেল হয়ে উঠেছে। কংক্রিটের নগরায়নের প্রতিযোগীতা আর অসুস্থ বাতাসের বাইরে রাজধানীর অদুরের এই সবুজ উপত্যকাকে রক্ষা করাটাও সমাজের যার যার জায়গায় থেকে দায়বদ্ধতা আছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা।